বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ০৫:১৭ পূর্বাহ্ন

সালাম না দিলে শান্তি নেই গণরুমেও

সালাম না দিলে শান্তি নেই গণরুমেও

স্বদেশ ডেস্ক:

মধ্যরাতে তীব্র শীতে বাইরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছেন একদল শিক্ষার্থী। সবার মনেই আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা। ভেতরে ইমিডিয়েট সিনিয়র এবং পলিটিক্যাল বড় ভাইরা জটলা পাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন- কীভাবে আজ ‘গেস্টরুম’ নেওয়া হবে। দীর্ঘক্ষণ আলাপ-আলোচনার পর ডাকা হয় নবীনদের। সারিবদ্ধভাবে প্রবেশ করে তারা। শুরু হয় মানসিক, আবার কখনো কখনো শারীরিক নির্যাতন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে আবাসন সংকটকে পুঁজি করে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের পরিচালিত একটি কার্যক্রম হলো

‘গেস্টরুম বা অতিথি কক্ষ’। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের হলে রাখার বিনিময়ে নিজেদের কর্মসূচিতে তাদের ব্যবহারের দীক্ষা দেওয়া হয় এতে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮ হলে ১৩০টি গণরুম, ছাদ, বারান্দা মিলে প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থী তাতে গাদাগাদি করে থাকেন। সপ্তাহের অধিকাংশ দিনেই রাজনৈতিক ‘শিষ্টাচার’ শেখানোর নামে তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে

নির্যাতন চালানো হয়। মাথা গোঁজার ঠাঁইটা ঠিক রাখতে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রতি অনুগত থাকেন প্রায় সবাই। নিয়মিতই অংশ নেন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে।

একাধিক শিক্ষার্থী বলেন, আবাসিক হলে থাকতে হলে গেস্টরুমে শেখানো নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। নেতাকর্মীরা যখন যেখানে ডাকেন, সেখানেই যেতে হয়। কেন্দ্রীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের নেতাদের ‘প্রটোকল’ দিতেও যেতে হয় যে কোনো জায়গায়। দলীয় কর্মসূচি তো আছেই। এসব কাজ করতে গিয়ে কোথাও কেউ ‘অপরাধ বা বেয়াদবি’ করলে পেতে হয় শাস্তি।

গেস্টরুমে কী শেখানো হয় : মূলত হলের রাজনৈতিক বড় ভাইকে সালাম দিয়ে হাত মেলানো, হ্যান্ডশেক করার সময় বড় ভাইয়ের হাতে চাপ না দেওয়া, হ্যান্ডশেকের সময় বাঁ হাত পেছনের দিকে রাখা, বড় ভাইদের সামনে না হাসা ইত্যাদি শেখানো হয়। গেস্টরুমের নিয়মানুযায়ী, ক্যাম্পাসে কেউ ‘অপরাধ’ করলে রাতেই তাকে জরুরিভাবে ডাকা হয় বিচারের জন্য। আর অপরাধ বলতেÑ কাউকে সালাম না দেওয়া, কর্মসূচিতে না যাওয়া, ডাক দেওয়ার পরও না শুনতে পাওয়া, কর্মসূচির আগে অসুস্থতার অজুহাত দেওয়া, ক্যান্টিনে ও পাঠকক্ষে জ্যেষ্ঠদের আসনে বসা ইত্যাদিকে বোঝায়। আবার দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছাড়া প্রথম বর্ষের কেউ অন্য কাউকে কোনো বিষয়ে অভিযোগ করলে সেটাও অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি যে স্বপ্ন নিয়ে ঢাবিতে এসেছিলাম, গেস্টরুমের এই বাজে অবস্থা দেখে নিরাশ হয়ে পড়েছি। এটাকে এক ধরনের দাসপ্রথা হিসেবেই গণ্য করা যায়। নিজের বাকস্বাধীনতা বলতে কিছু নেই এখানে। ক্ষেত্রবিশেষে সিনিয়র ভাইকে ভুলে সালাম না দেওয়ার কারণে চড়-থাপ্পড়ও খেতে হয়। ঝাড়ি দেওয়ার সময় নেতারা এমন জোরে চিল্লায়, নিজেকে খুব অসহায় লাগে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, নড়াচড়া করা যাবে না, মাথা নাড়ানো যাবে নাÑ আরও কত কী।’

বছরের শুরুতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে যে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, সেটাকে ধারাবাহিক পরিস্থিতিরই অংশ বলছেন শিক্ষার্থীরা। ওই রাতে চার ছাত্রকে ছাত্রশিবিরের কর্মী সন্দেহে ব্যাপক মারধর করেন হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এর পর তাদের শাহবাগ থানায় সোপর্দ করা হয়। পরদিন দুপুরে অবশ্য পুলিশ তাদের ছেড়ে দেয়। এর পর ঘটনার বিচারের দাবিতে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অবস্থান নেন মারধরের শিকার ছাত্র মুকিমুল হক চৌধুরী। এমন ঘটনা অবশ্য ঢাবিতে প্রথম নয়। মূলত ভিন্ন মতাবলম্বী হলে, এমনকি কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত শত্রæতার জেরেও ‘শিবিরকর্মী’ আখ্যা দিয়ে মারধরের নজির রয়েছে। ২০১৫ সালের ২ আগস্ট রাতে বিজয় একাত্তর হলে আইবির ছাত্র হোসাইন মিয়াকে শিবিরকর্মী আখ্যা দিয়ে বেধড়ক মারধর করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। অথচ হোসাইন ছিলেন তাদেরই কর্মী। ২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট রাতে জিয়াউর রহমান হলে প্রথম বর্ষের ছাত্র মনিরুল ইসলামকে একই অপবাদে পিটিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে জানা যায়, মনির শিবিরের কেউ নন, তার পুরো পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ওই ঘটনার চার দিন পর হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের পাঁচ শিক্ষার্থীকে শিবিরকর্মী সন্দেহে মারধর করে পুলিশে দেওয়া হয়েছিল। সহপাঠীর কাছ থেকে ক্যালকুলেটর ধার নেওয়া নিয়ে ২০১৮ সালের ৬ ফেব্রæয়ারি এসএম হলে মারধরের শিকার হন দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী এহসান রফিক। হলের একটি কক্ষে আটকে রেখে তাকে ছাত্রলীগ নির্যাতন করে বলে অভিযোগ। এতে এহসানের একটি চোখের কর্নিয়া গুরুতর জখম হয়। গত বছরের ১ এপ্রিল রাতে এসএম হলে মাস্টার্সের ছাত্র ফরিদ হাসানকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়। তার পক্ষে বিচার চেয়ে পরদিন প্রাধ্যক্ষের কাছে স্মারকলিপি দিতে গিয়ে ছাত্রলীগের হাতে লাঞ্ছিত হন ডাকসুর ভিপি নুরুল হক। লাঞ্ছনা ও মারধরের শিকার হন কয়েকজন নারীনেত্রীও। ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘কাউকে পেটানো হয় শিবির-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে, কাউকে আবার কর্মসূচিতে না যাওয়ায়, কেউ মার খায় অবাধ্যতার অজুহাতে। তাদের কোনো বিচার হয় না। এভাবেই বছরের পর বছর ধরে নির্যাতনের এ চক্র চলে আসছে। এ ক্ষেত্রে অনেকটাই নির্বিকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।’

গেস্টরুমের বিষয়ে জানতে চাইলে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভ‚ইয়া বলেন, ‘আমি গেস্টরুম করানোর বিষয়টি শুনেছি। এটা আসলেই দুঃখজনক। ব্যক্তিগতভাবে আমি এর বিপক্ষে। অনেক সময় অনেক কিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। তাই আমরা হলের গেস্টরুমগুলো সিসিটিভির আওতায় নিয়ে আসব, যেন কাউকে নির্যাতন করলে শনাক্তের মাধ্যমে বিচার করা যায়।’

নির্যাতনের বিষয়ে বিশ^বিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের সমস্যা, তাদের ভাবনা, রাজনৈতিক ভাবনা নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করে। এটা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম। তবে কিছু নেতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতিও আছে। এটির সঙ্গে সুনির্দিষ্ট কোনো ছাত্র সংগঠন জড়িত, বিষয়টি এমন নয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সংকটের সমাধান এবং হলে গণরুম না থাকলে এ সমস্যা দূর হয়ে যাবে।’

প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রব্বানী বলেন, ‘গেস্টরুম ও গণরুম বন্ধ করার জন্য আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছি। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের কাছে একটা অনুরোধ, তারা যেন প্রশাসনের মাধ্যমে হলে ওঠে। তারা যদি কোনো সংগঠনের সাহায্যে হলে ওঠে, তা হলে বিভিন্নভাবে তাদের ব্যবহারের সুযোগ থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে যে থাকবে, শুরু থেকেই বৈধতা নিয়ে থাকবে। এ বৈধতা থাকে না বলেই তারা একটি পরিস্থিতির শিকার হয়।’

একই কথা জানিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান, ‘গণরুম ও আবাসন সংকট নিরসনে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি, স্থায়ী সমাধানের জন্যও প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে ইতোমধ্যে। এ ক্ষেত্রে বেশকিছু অগ্রগতিও হয়েছে। তবে গণরুম সমস্যা এত দীর্ঘদিনের যে, দিনক্ষণ বেঁধে এর সমাধান সম্ভব নয়।’

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877